সোমবার, ০৭ Jul ২০২৫, ০৩:৪৩ অপরাহ্ন
যুক্তরাজ্যের লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর দেশে নির্বাচনের হাওয়া বইছে। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনে (ইসি)। নির্বাচনের বিভিন্ন প্রস্তুতি নিতে দফায় দফায় বৈঠক করছেন কমিশনের সদস্যরা।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালার সংশোধনী, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র স্থাপন এবং ব্যবস্থাপনা নীতিমালা, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালা এবং নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংবাদিক/গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য নীতিমালার সংশোধনী ওয়েবসাইটে প্রকাশের ব্যবস্থার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। দ্রুত সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রধান আইন আরপিও সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচন বন্ধে নির্বাচন কমিশন এবং প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের ক্ষমতা পুনর্বহালের উদ্যোগ নিতে ইসি সচিবালয়কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন এবং সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ কাজও দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসি। যারা জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবেন, তাদের প্রশিক্ষণের কর্মপরিকল্পনা ইসিতে উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে। আসন্ন সংসদ নির্বাচনের ম্যানুয়াল তৈরির জন্যও প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসি। মূলত লন্ডন বৈঠকের পরেই জাতীয় নির্বাচনের হাওয়া বইছে ইসিতে।
অথচ কিছু দিন আগেও অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির বিরোধ লক্ষ করা যাচ্ছিল। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে বিএনপিদলীয় প্রার্থী ইশরাক হোসেনকে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেওয়ায় সেই বিরোধ আরও তীব্র হয়। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বিএনপি পাল্টাপাল্টি সমাবেশও করে। বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য বারবার তাগিদ দিলেও এনসিপি সংস্কার ও গণহত্যার বিচারের দিকে বেশি নজর দেয়। ফলে কবে নাগাদ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে এ নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল।
পবিত্র ঈদুল আজহার আগের রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন। প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণার ব্যাপারে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানায়। এর আগে বিএনপির নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ এনে তিনজন উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি জানান।
এমনই এক পরিস্থিতির মধ্যে গত ১৩ জুন (শুক্রবার) যুক্তরাজ্যের লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার কাছে আগামী বছরের রমজানের আগে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তাব করেন। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও মনে করেন ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয়।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন যে তিনি আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।
তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার এই অবস্থানকে স্বাগত জানান এবং দলের পক্ষ থেকে তাকে ধন্যবাদ জানান। প্রধান উপদেষ্টাও তারেক রহমানকে ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য ধন্যবাদ জানান বলে এক যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়।
ওই বৈঠকের পর ফেব্রুয়ারিতেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেকে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ধরে নিয়ে তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ফলে হাতে সময় আছে মাত্র আট মাস। আগামী রমজান মাস শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহে (ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে) নির্বাচন আয়োজন করতে হলে চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ দিকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে হবে। সেইভাবে এগিয়ে যাচ্ছে ইসি। এই হিসেবে চলতি বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ, চলতি জুনের মধ্যে ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা, জুলাই-আগস্টের মধ্যে নতুন দলের নিবন্ধন গেজেট প্রকাশ করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।
ভোটের সময়সূচি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, ফেব্রুয়ারি বা এপ্রিলের যে সময়েই নির্বাচন হোক না কেন প্রস্তুতি রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। তফসিল ঘোষণার সময় ভোটার তালিকা তৈরি থাকতে হবে। যেদিন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয় তার মাস দুয়েক আগে তফসিল হয়। মানে ৫০-৬০ দিন আগে হবে। ভোটের আট-দশ মাস আগে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ এ মুহূর্তে ঘোষণা সম্ভব নয়। ভোটের সম্ভাব্য সময় নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে ধারণা পাওয়ার পরই সিদ্ধান্ত নেবে ইসি।
তফসিল কবে? জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘এতদিন তো সরকারই আলোচনা করেছে, আমরা করিনি। উনাদের পজিশনটা আমাদের বুঝতে হবে। বোঝার পরে যেদিন তারিখ ঠিক হবে, অ্যারাউন্ড দুই মাস আগে তফসিল ঘোষণা হবে। ঐতিহাসিকভাবে তা-ই, ৫৫ থেকে ৬০ দিন আগে তফসিল ঘোষণা করবো। সরকারের সঙ্গে আলোচনার পর ভোটের সম্ভাব্য সময়সীমা নিয়ে ধারণা পেলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
‘ফেব্রুয়ারিতে হোক বা এপ্রিলে হোক- জাতীয় নির্বাচন যখনই হোক, আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। আগে আমাদের বলা হয়েছিল ডিসেম্বর থেকে জুন, আমরা সে টাইম মাথায় রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছি ও এগিয়ে যাচ্ছি।’ বলছিলেন এ এম এম নাসির উদ্দিন।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালা, নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংবাদিক/গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য নীতিমালা এবং বিদেশি সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের নীতিমালা এরই মধ্যে অনুমোদন করা হয়েছে। নতুন রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালার সংশোধনী ২১ মে কমিশন সভায় তোলা হলেও তা ফেরত পাঠানো হয়। ওইদিন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র স্থাপন এবং ব্যবস্থাপনা নীতিমালায় নীতিগত অনুমোদন করা হলেও তা চূড়ান্ত করেনি ইসি। ‘লন্ডন বৈঠক’-এর পরিপ্রেক্ষিতে গত রোববার কমিশন এসব বিধিমালা-নীতিমালার সংশোধনী দ্রুত শেষ করার ওপর জোর দিয়েছে।
লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকের পরে সিইসি ও চার কমিশনার ইসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এছাড়া সিইসি নির্বাচন কমিশনারদের নিয়ে দীর্ঘ সময় বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে আখতার আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্যে রয়েছি। আজকেও (মঙ্গলবার) নানা মিটিং করছি, আগামীতেও করবো। আমাদের এখন সব কাজই কিন্তু জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। আমরা এক ধরনের দৌড়ের ওপরে আছি।’
ইসি সূত্র আরও জানায়, জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বুধ বা বৃহস্পতিবার কমিশনের একটি সভা হবে। নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজগুলোর অগ্রগতি তুলে ধরা হবে সেখানে। সংসদ নির্বাচনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ খসড়া তালিকা ওই বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। ২০০১ সালের সীমানায় ফিরে যাওয়ার ইসির যে পরিকল্পনা ছিল, জটিলতা তৈরির আশঙ্কায় সেই পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে কমিশন। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রশাসনিক অখণ্ডতা বজায় রেখে সীমানায় পরিবর্তন করে খসড়া তৈরি করা হচ্ছে।
নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন কার্যক্রম নিয়ে বৈঠক করেছে ইসি। ২২ জুন নতুন দল নিবন্ধনে আবেদন করার সময় শেষ হবে। এরই মধ্যে যেসব দল আবেদন করেছে, তাদের কাগজপত্র যাচাই করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। তবে নিবন্ধন পাওয়ার জন্য এখনো ইসিতে আবেদন করেনি এনসিপি। তবে নতুন দলের নিবন্ধনের সময় আর বৃদ্ধি করবে না ইসি।
আসন্ন সংসদ নির্বাচনে নানান ধরনের সামগ্রী মুদ্রণ করতে কী পরিমাণ পেপার লাগবে, বাজেট কত হতে পারে এবং কেনাকাটা থেকে মুদ্রণে কত সময় লাগবে তা নিয়ে প্রস্তুতিমূলক বৈঠক করেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন সামনে রেখে প্রয়োজনীয় কাগজ কেনাকাটা ও মুদ্রণ কাজ ভোটের আগে চার মাসের মধ্যে করার প্রস্তুতি রাখছে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়।
সবশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় ১ লাখ ৬১ হাজার রিম কাগজ কেনা হয়েছিল। সেবার ৩৩ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছিল। এবার অন্তত ১ লাখ ৭০ হাজার রিম কেনার প্রয়োজন হতে পারে। শুধু কাগজ কেনায় ৩৬ কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে।